শুরুটা হলো এবার দারুণ! শুক্রবার ছুটির দিন। শীতের দাপটও কমে এসেছে রাজধানীতে। বিকেলের অবসরে সাধারণত দারাপরিবার নিয়ে বেড়াতে বের হন নগরবাসী। এমন একটা পরিবেশে খুলে গেল বাংলা একাডেমীর বইমেলার ফটক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতক্ষণ ছিলেন, নিরাপত্তারক্ষীরা ততক্ষণ আটকে রেখেছিলেন ফটকের সামনে বেড়ে ওঠা জনসমাগম। এদিকে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এল। মেলা উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর যেই খুলে দেওয়া হলো দ্বার, অমনি বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো জনস্রোত। নিমেষে মেলার মাঠ জনাকীর্ণ। দেখে বোঝার উপায় নেই মেলার বয়স ঘণ্টা দুয়েকও পেরোয়নি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান: মেলা এবার ৩০ বছরে পড়ল। গ্রন্থানুরাগীদের সমাগম বাড়ছে প্রতিবছরই। বাড়ছে প্রকাশনা সংস্থাও। মেলার পরিসর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা উঠছিল কয়েক বছর থেকেই। এবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও বিশেষ গুরুত্ব পেল বিষয়টি। স্বাগত ভাষণে একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান সামনের বছরগুলোতে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা সম্প্রসারণের প্রস্তাব দিলেন। বাংলা একাডেমীর মাঠে যথারীতি থাকবে মূল মঞ্চ। এখানে উদ্বোধনীসহ প্রতিদিন আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রস্তাবটি বাস্তবসম্মত বলে সমর্থন দিলেন। লেখক-প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই আলোচনা করে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয়ে মেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার আশ্বাসও দিলেন তিনি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন একাডেমীর সভাপতি শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে মুদ্রিত বইয়ের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির উন্নতি হোক, পাশাপাশি মুদ্রিত বইও আমাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে থাকুক।’ বাংলা একাডেমীর বইমেলা মুদ্রিত বইয়ের প্রচার-প্রসারে তার ভূমিকা অব্যাহত রেখে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সাহিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। প্রকাশকদের পক্ষে মহিউদ্দিন আহমেদ বক্তৃতা করেন। শুরুতেই ছিল খায়রুল আনাম শাকিলের নেতৃত্বে ছায়ানটের শিল্পীদের পরিবেশনায় জাতীয় সংগীত। এরপর পবিত্র গ্রন্থ কোরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক থেকে পাঠ। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা। এরপর একুশের গান ও আলোচনা পর্ব। শেষে ছিল খুলনার শিশু আবৃত্তিকার শাবাব সায়েমের বিদ্রোহী কবিতা ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ অনুসরণে আবৃত্তি। প্রধানমন্ত্রী এই খুদে আবৃত্তিকারের আবৃত্তিতে মুগ্ধ হয়ে তার লেখাপড়ার সুবিধার্থে এক লাখ টাকা উপহার দেন। এই টাকা তার নামে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
হুমায়ূনের স্মৃতি: তিনি নেই, তবে তাঁর ছায়া ছড়িয়ে আছে সারা মেলায়। পাঠকের মুখে, নতুন বইয়ে, স্টলের মাথায় টাঙানো বিশালাকার প্রতিকৃতিতে জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ বিরাজ করছেন গ্রন্থমেলায়। অবসর প্রকাশনীর স্টলের নামফলকের ওপর তাঁর প্রতিকৃতি। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেখা, ‘তাঁর হাত ধরেই আমাদের যাত্রা শুরু’। ‘নয়ন তোমায় পায় না দেখিতে’ লেখা কাকলী প্রকাশনীর স্টলের ছাদে টাঙানো ছবির পাশে। অন্যপ্রকাশের স্টলের সজ্জায় শোকের কালো ছায়া। সেখানে হুমায়ূন আহমেদের সাদা-কালো ছবি। অন্যপ্রকাশে প্রথম দিনেই এসেছে তাঁর ভ্রমণসমগ্র। এবার মেলাও উৎসর্গ করা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতির প্রতি। মূল মঞ্চে প্রবেশের সামনেই তাঁর প্রতিকৃতি-সংবলিত ফলকে উৎসর্গলিপি। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উল্লেখ করা হয়নি যে মেলাটি তাঁর স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের অন্যতম প্রকাশক অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম বললেন, ‘দেশের প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ ও মেলার এই পর্যায়ে আসার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অনন্য। তাঁর প্রতি মেলা উৎসর্গ করা হয়েছে। অথচ সে কথা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উল্লেখই করা হলো না। বিষয়টি আমাদের কাছে দুঃখজনক মনে হয়েছে।’
উইকিলিকসে বাংলাদেশ: গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে বিশ্বজোড়া সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকসে বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল, সেসব নিয়েই মশিউল আলমের নতুন বই উইকিলিকসে বাংলাদেশ। বইটি কিনতে পাঠকেরা ভিড় জমিয়েছিলেন প্রথমা প্রকাশনীর স্টলের সামনে। এ বছর প্রথমার স্টলটি নজরুল মঞ্চের পূর্ব পাশে। স্টলের সজ্জাও হয়েছে চমৎকার। এবার নিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রথমা অংশ নিচ্ছে মেলায়। মানসম্মত বইয়ের বৈচিত্র্যময় প্রকাশনা নিয়ে প্রথমা ইতিমধ্যে পাঠকদের কাছে আস্থার জায়গা করে নিয়েছে। এবারও মেলায় আসছে প্রথমার বিষয়-বৈচিত্র্যে আকর্ষণীয় একগুচ্ছ নতুন বই। প্রথম দিনে হরিশংকর জলদাসের নতুন উপন্যাস মোহনার কাটতিও ছিল যথেষ্ট। বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানালেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইগুলোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন ক্রেতারা।
ভিড় সামলাতে হিমশিম: ‘নতুন বইও তেমন আসেনি। কর্মীও কম। কিন্তু যত লোক আসছে, ভিড় সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি।’ বলছিলেন মাওলা ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপক অনুপ দত্ত। সন্ধ্যায় তাঁদের স্টলের সামনে ক্রেতারা ভিড় জমিয়েছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবালের নতুন বই গাব্বু কিনতে।
নতুন বইয়ের মধ্যে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত সম্প্রতি প্রয়াত আবদুশ শাকুরের গল্পগ্রন্থ ঘোর, কথা থেকে প্রকাশিত কবি নির্মলেন্দু গুণের আত্মজীবনী মহাজীবনের কাব্য এসেছিল মেলায়।
এবার সময় প্রকাশনী থেকে ১২ খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধ কোষ প্রকাশিত হচ্ছে মুনতাসীর মামুনের সম্পাদনায়। আজ বিকেল চারটায় এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান হবে জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে।
আজ শনিবার মেলার ফটক খুলবে বেলা ১১টায়। প্রথম দিনেই মেলার মাঠ জমজমাট—কাজেই দ্বিতীয় দিনেও যে তার ব্যত্যয় হবে না, তা ধরেই নেওয়া যায়।
No comments:
Post a Comment